Saturday, February 25, 2023

Newscope First Election in India

২৫ জানুয়ারি -জাতীয় ভোটার দিবস, ফিরে দেখা দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন নিলয়কুমার সাহা ২৫ অক্টোবর ১৯৫১ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এই চার মাস ব্যাপী সারাদেশে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। সারাদেশে ১৭,৩২,১৩,৬৩৫ জন তালিকাভুক্ত ভোটারের ৪৫.৬৭ শতাংশ অর্থাৎ ১০,৫৯,৪৪,৪৯৫ জন ভোটার লোকসভা নির্বাচনে ভোটদান করেন। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটার সংখ্যা ছিল ১০,৩৮,০১, ১৯৯টি। একাধারে ভোটগ্রহণ এবং ফল ঘোষণার কাজ চলতে থাকে সারা দেশব্যাপী। সারাদেশে ৭,০০,০০০ ভোট কর্মী ২,২৪,০০০ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভোট কার্য পরিচালনা করেছিলেন । এই মহাযজ্ঞে প্রশাসনিক সহায়তায় শামিল হয়েছিলেন ২,২৪, ০০০ বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশকর্মী। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পটভূমিতে রাজনৈতিক দ্বৈরথ বর্তমান সময়ের মতো কলুষিত না হলেও একেবারে বিষমুক্ত ছিল না। তবে রাজনৈতিক হানাহানির বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের 'জুয়া খেলায়' সুকুমার সেনের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিল এবং সদ্য স্বাধীন একটি দেশ সারা বিশ্বের কাছ থেকে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল। ভারতবর্ষের প্রথম সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে সারা বিশ্ব যে উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছিল তা আজও দেশবাসীকে গর্বিত করে। ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি দিনটিকে তদানীন্তন ভারত সরকার জাতীয় ভোটার দিবস হিসাবে ঘোষণার পাশাপাশি প্রতিবছর ওই দিনটিকে জাতীয় ভোটার দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দিনটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পৌঁছতে হলে সময় যন্ত্রে আমাদের আটটি দশক পিছনে ফিরে যেতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ সংসদ 'ইন্ডিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্টস অ্যাক্ট ১৯৪৭' অনুমোদন করে এবং ওই আইন অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পন্ডিত জহরলাল নেহের স্বাধীন ভারতবর্ষের তদারকি সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী রূপে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন তদারকি সরকার দেশ পরিচালনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সংসদীয় পরিকাঠামো রচনায় ব্রতী হন। স্বাধীন দেশের সংবিধান রচয়িতারা এই কাজ ত্বরান্বিত করতে ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ শাসনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনের নীতি অনুসরণ করেন। এই নীতি বাস্তবায়নের সংবিধান প্রনেতারা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তা হল কেবলমাত্র অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনই প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি যা সুদৃঢ় সংসদীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সক্ষম। তাদের মতে স্বাধীন নিরপেক্ষ এবং কার্যকরী একটি সংস্থা অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন সুনিশ্চিত করতে সক্ষম। এমতাবস্তায় সংবিধান রচয়িতারা ইউনাইটেড কিংডমের কেন্দ্রীয় নির্বাচন আয়োগ এর ধারণা এবং ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার প্রাদেশিক নির্বাচন আয়োগ এর ধারণার তুলনামূলক পর্যালোচনা মধ্যে দিয়ে সারাদেশে নির্বাচনী কার্যক্রমে সমতাবিধানের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় নির্বাচন আয়োগের ধারণাটি গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হলেও নাগরিকত্ব আইনের ৫,৬,৭,৮,৯ নম্বর ধারা এবং সংবিধানের ৩২৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ভারতীয় নির্বাচন আয়োগ। ভারতীয় নির্বাচন আয়োগ এর কার্যক্রম শুরু হয় ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হওয়ার একদিন আগে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৫ জানুয়ারি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার একষট্টি বছর পর। ২৫ জানুয়ারি দিনটিকে জাতীয় ভোটার দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্বাধীন ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ , আইসিএস সুকুমার সেনকে রাজ্যের প্রথম মুখ্য সচিবের পদে নিযুক্ত করেন এবং ওই পদে শ্রী সেন ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সুপারিশেই প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার সুকুমার সেনকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে নিযুক্ত করেন । ১৯৫০ সালের ২১ মার্চ থেকে ১৯৫৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুকুমার সেন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময়ে তার নেতৃত্বে ১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালের দেশের দুটি সাধারণ নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। দায়িত্ব গ্রহণের ১ বছর ৭ মাসের মধ্যে শ্রী সেন দেশের ১৪ টি জাতীয় এবং ৬৩ টি প্রাদেশিক ও স্থানীয় রাজনৈতিক দলের মোট ১৭৫০০ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণের উদ্দেশ্যে যে কর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন তা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। ২১ বছর বয়সোর্ধ ৭৬ মিলিয়ন ভারতবাসীকে তিনি গণতন্ত্রের এই উৎসবে ভোট দানকারী হিসেবে যুক্ত করেছিলেন , যাদের শতকরা ৮৫ শতাংশ ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন। সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর ভোটদাতাদের দ্বারাই নির্বাচিত হয়েছিল স্বাধীন দেশের ৪৮৯ আসন বিশিষ্ট লোকসভা এবং ৩২৮৩ আসন বিশিষ্ট বিভিন্ন প্রাদেশিক বিধানসভার জনপ্রতিনিধিগণ। এই জনপ্রতিনিধিদের হাত ধরেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের। শ্রী সেন কিভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন তা আজ ইতিহাস। সারা বিশ্ব চরম বিষয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের মহাযজ্ঞ। সুকুমার সেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নির্বাচন আয়োগএর যথার্থ পরিচালনায় এবং দেশবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণে রচিত হয়েছিল ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের মহাকাব্যিক ইতিহাস। পন্ডিত নেহেরুর ভাষায় " আমরা ছোট মাপের মানুষ কিন্তু যোগ দিয়েছি বিরাট এক কাজে। এই কাজটা বিরাট , তাই বিরাটত্বের কিছুটা ছোঁয়া আমাদের গায়েও এসে লাগে। সে কৃতিত্বের আঁচ আজ আমরা পাই" দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন পরিচালনায় সুকুমার সেনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন আয়োগ দেশের সংবিধান, ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে অনুসৃত নির্দেশিকা অনুসরণ করে নানান প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সারাদেশে নির্বাচন কেন্দ্রের বিন্যাস , পুনর্বিন্যাস , সংরক্ষিত আসন নির্দিষ্টকরণ, ক্রমবর্ধমান উদ্বাস্তু সমস্যা এবং সর্বোপরি ভোটার তালিকা প্রণয়নের মত অত্যন্ত দুরূহ কাজের পাশাপাশি অধিকাংশ নিরক্ষর ভোটদাতার ভোটগ্রহণ এবং ফল ঘোষণার কাজ যে দক্ষতা , দ্রুততা এবং দৃঢ়তার সাথে সম্পাদন করেছিলেন তা আজও আমাদের বিস্মিত করে। প্রধানত পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে ভারতবর্ষ মুখী হিন্দুদের বিরামহীন স্রোতের কারণে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন পরিচালনায় ভোটার তালিকা প্রস্তুতির কাজ বারবার ব্যাহত হয়েছিল। পাশাপাশি তুলনায় কম হলেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে মুসলমানদের পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ এবং বারবার বর্ধিত নির্দিষ্ট তারিখের প্রেক্ষিতে ২১ বছর বয়স উর্ধ দেশবাসীকে চিহ্নিতকরণের সমস্যাও ভোটার তালিকা প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। এই সমস্যা সঙ্কুল পরিস্থিতিতে দেরি হলেও নির্বাচন আয়োগ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ভোটার তালিকা প্রস্তুত, প্রাথমিক ভোটার তালিকা প্রকাশ এবং সর্বোপরি ভোটার তালিকা সংশোধন ও সংযোজন এর কাজ সম্পাদন করেছিল। দেশের সর্বাধিক জনসাধারণকে আইনে বর্ণিত নির্দেশ অনুসারে ভোট উৎসবে শামিল করাই ছিল নির্বাচন আয়োগের লক্ষ্য। এই প্রসঙ্গে শ্রী সেন ঘোষণা করেন " আইন অনুসারে পরিবর্তিত যোগ্যতা মানের বয়েস এবং তারিখ অনুযায়ী সকল যোগ্য নাগরিক ভোটার তালিকায় যুক্ত হবেন। এই কাজ সবেমাত্র আরম্ভ হয়েছে।। প্রসঙ্গত আগের ভোটার তালিকা সম্পর্কিত কোন অভিযোগই আসেনি। যদি কোন নির্দিষ্ট অঞ্চল অথবা রাজ্য অথবা কোন নির্বাচন কেন্দ্রের ভোটার তালিকা সংক্রান্ত নির্দিষ্ট অভিযোগ আসে তাহলে অবশ্যই আমরা সেই অভিযোগ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখব। যদি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুতির পরেও দেখা যায় কিছু যোগ্য নাগরিক ভোটার তালিকায় যুক্ত হননি তবে সেক্ষেত্রেও ভোটার তালিকা সংযোজিত হবে।" প্রসঙ্গত উল্লেখ্য চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে শ্রী সেন লক্ষ্য করেন উত্তর ভারতের প্রায় ২৮ লক্ষ মহিলা ভোটার কারোর কন্যা , কারোর স্ত্রী অথবা কারোর মা এই নামে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। বিষয়টি নজরে আসা মাত্রই শ্রী সেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের নির্দেশ দেন ওই ভোটারদের নিজে নিজে নামে তালিকাভুক্ত করনের। কিন্তু ওই মহিলাগণ নিজের নামে তালিকাভুক্ত হতে অসম্মত হওয়ায় আইনের রক্ষক শ্রী সেনের নির্দেশেই ওই ২৮ লক্ষ মহিলা ভোটারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। যদিও শ্রী সেনের ঐকান্তিক প্রয়াসেই ওই মহিলা ভোটারগণ দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে নিজের নিজের নামেই ভোটার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য পৃথক পৃথক নির্বাচনী প্রতিক নির্দিষ্টকরণের মধ্য দিয়ে, সুকুমার সেন পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ক্ষেত্র নির্মাণ করেছিলেন। শ্রী সেন উপলব্ধি করেছিলেন দেশের ৮৫% অক্ষর জ্ঞানহীন ভোটারদের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বহু রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে থেকে কেবলমাত্র নামের ভিত্তিতে পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেওয়া অসম্ভব। সেই কারণেই তিনি প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার্য নানান উপকরণ যেমন জোড়া বলদ, হাতি, কাস্তে হাতুড়ি, প্রদীপ, উদীয়মান সূর্য, মানুষের হাত, দন্ডায়মান সিংহ ইত্যাদি নির্দিষ্ট করেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে। শ্রী সেনের উদ্ভাবনী ভাবনার সার্থক প্রয়োগের ফলশ্রুতিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন কারণে বাজেয়াপ্ত ভোটের পরিমাণ ৪ শতাংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। উত্তর আধুনিক ভারতবর্ষ আজও সুকুমার সেন সৃষ্ট পথেই ধাবমান।। কেবল নির্বাচনী প্রতীকই নয়, ভোট বাক্স এবং ভোটপত্রের নকশা শ্রী সেন নিজেই প্রস্তুত করেছিলেন। লোকসভা এবং বিধানসভার জন্য আলাদা রঙের ভোট বাক্স এবং ভোটপত্রের ব্যবহারের নির্দেশ এবং জাল ভোট রুখতে অনপনেয় কালীর ব্যবহারের পরিকল্পনাও তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৯৫৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সুকুমার সেন প্রকাশিত রিপোর্ট "অন দা ফাস্ট জেনারেল ইলেকশন ইন ইন্ডিয়া ১৯৫১ - ৫২ " থেকে জানা যায় ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার জন্য - টাইপ এবং ক্রমানুক সাজানোর জন্য ১৬৫০০ কর্মীকে চুক্তি ভিত্তিতে ছ মাসের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। ৩৮৪২১৫ রিম কাগজের ব্যবহার হয়েছিল ভোটপত্র তৈরি করতে। ভোট দানের পর ভোটপত্র সংরক্ষণের জন্য ২ মিলিয়ন অর্থাৎ কুড়ি লক্ষ ভোট বাক্স তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়েছিল ৮২০০ টন স্টিল এবং জাল ভোট রুখতে ব্যবহৃত হয়েছিল ৩৮৯৮১৬ ফাইল কালি। শ্রী সেনের অনুরোধেই সমকালীন বিজ্ঞানীরা এমন কালি প্রস্তুত করেছিলেন যা দেহের কোন অংশে একবার লাগলে দীর্ঘদিন তা উজ্জ্বল থাকবে। এই প্রসঙ্গে এক মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শ্রী টি এন সেশনের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। কারণ সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য তিনি সচিত্র ভোটার পত্রের প্রবর্তন করেন। প্রচারবিমুখ সুকুমার সেন দেশের আপামার জনসাধারণকে নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে সচেতন এবং আত্মনির্ভর করে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং এই কাজ যথাযথ সম্পাদনে শ্রীসেন বেতার ,মুদ্রণ এবং চলচ্চিত্র ইত্যাদি মাধ্যমকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৫১ সালের ২৭ জুন দিল্লি অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে ভোটারদের উদ্দেশ্যে শ্রী সুকুমার সেন এর – ‘কিভাবে একটি ভোট দান হবে’ শীর্ষক বক্তৃতা সম্প্রচারিত হয় । এই বেতার বার্তায় শ্রী সেন বলেন " দেশের বাতাসে এখন ভোটের গন্ধ এবং এই সময় দেশের জনসাধারণকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। যে সকল জনগণ তাদের আইনসম্মত অধিকারের বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন তারা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত ভোটার তালিকা পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছেন। আনুমানিক দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। কিভাবে ভোট দিতে হবে , এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন একটি ভোটপত্রের ওপর ভোটদাতার কর্তব্য সম্পর্কে কোন চিহ্ন বা নির্দেশিকার উল্লেখ থাকবে না। প্রত্যেক প্রার্থীকে একটি করে ভোট বাক্স বরাদ্দ করা হবে এবং ওই বাক্সের উপর ওই প্রার্থীর নির্বাচনী প্রতীক পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হবে। ভোটদাতা এই প্রতীক নির্দেশিত তার পছন্দের প্রার্থীর ভোট বাক্সে ভোটপত্রটি ফেলে দেবেন। মনে রাখতে হবে বহু আসন বিশিষ্ট নির্বাচনী কেন্দ্রের ক্ষেত্রে কোন ভোটদাতাই একটি ভোট বাক্সে একের অধিক ভোটপত্র ফেলবেন না। যদি কোন ভোটদাতাএই কাজ করেন তবে একটি ছাড়া সকল ভোট বাতিল বলে গণ্য হবে।“ মিথ্যা ছদ্মবেশ সম্পর্কে শ্রীসেন বলেন " অতীতে যেখানে সেখানে মিথ্যা ছদ্মবেশের অশুভ প্রয়োগ ছিল এই বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন করে কোন ভোট দাতাকে ভোটপত্র দেবার আগেই সেই ভোটদাতার তর্জনীতে অক্ষয় কালী নিয়ে দাগ দিয়ে দিতে হবে। একজন ভোটদাতা একবার ভোট দেয়ার পর পুনরায় ভোট দিতে পারবেন না কারণ সেই ভোটদাতা তর্জনীতে দেওয়া অক্ষয় কালির ছাপ ৭ থেকে ১০ দিন বিরাজ করবে। যদি কোন ভোটার ছদ্মবেশে অন্য কোন ভোটদাতার ভোট দিয়ে দেন তবে তিনি নিজের ভোট আর দিতে পারবেন না , কারণ প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ভোটার হিসেবে ভোটকেন্দ্রে যায়।" ভোট কেন্দ্রে ভোটারের যাতায়াত প্রসঙ্গে শ্রী সেন বলেন অতীতে প্রত্যেক ভোটদাতাই প্রার্থীর খরচে কোন গাড়িতে বা অন্য কোন উপায় ভোটকেন্দ্রে পৌঁছতেন। বর্তমানে প্রার্থী কর্তৃক ভোট দাতাদের জন্য ভোটের দিন যানবাহনের ব্যবস্থা করা ফৌজদারী অপরাধ বলে পরিগণিত হবে।। কাজেই ভোটদাতা নিজেদের খরচায় যানবাহনের ব্যবস্থা করে অথবা পায়ে হেঁটে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছাইবেন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করিবেন।" ১৯৫১ সালে নভেম্বর মাসে অল ইন্ডিয়া রেডিওর বাইশটি সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে ' ভারতীয় সংবিধান' 'প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার' 'ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ' ইত্যাদি বিষয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল। কেবল দিল্লি অল ইন্ডিয়া রেডিও শ্রী সুকুমার সেনের নির্বাচন বিষয়ক সাতটি বক্তৃতা সম্প্রচার করে। সম্ভবত সুকুমার সেনের উদ্যোগেই ভারতবর্ষের তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রকের ফিল্ম ডিভিশন Right and responsibility শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র প্রস্তুত করে। এই তথ্যচিত্রে মূলত ভোটারদের কাজ এবং কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছিল। 'ফিল্ম ডিভিশন' কতৃক তথ্যচিত্রটি ১৯৫১ সালের মার্চ মাসের শেষে তিন হাজারেরও বেশি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছিল। ওই বছরই 'ফিলম ডিভিশন' 'ডেমক্রেসি ইন অ্যাকশন' শীর্ষক আরেকটি ছবি ইংরেজি সহ আটটি প্রাদেশিক ভাষায় প্রস্তুত করে। নির্বাচন আয়োগ এর অনুরোধে ৭০ মিলিয়ন ভারতবাসীকে সঠিক উপায়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ অর্থাৎ ভোটদানে সক্ষম করে তুলতে 'ফিল্ম ডিভিশন' এই তথ্যচিত্রটি সারাদেশে ৬ সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শ্রী সুকুমার সেন ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে রাজ্যভিত্তিক নির্বাচন নির্ঘণ্ট চূড়ান্ত করেন। লোকসভার ৪৮৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ২৮৩৩টি মনোনয়নপত্র এবং সারাদেশের রাজ্য বিধানসভা গুলিতে ৩২৮৩ টি আসনের জন্য ২৩,২৮৭ টি মনোনয়নপত্র দাখিল হয়। এই বিপুল সংখ্যক মনোনয়নপত্র পরীক্ষা এবং প্রত্যাহারের পর লোকসভায় ১৮৭৪ জন এবং রাজ্য বিধানসভায় ১৫,৬৩১ জন প্রতিদ্বন্দ্বি নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অবশেষে স্বাধীনতার ভারতবর্ষে ১৯৫১ সালে ২৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার তিব্বত সীমান্তবর্তী হিমাচল প্রদেশের চিনি ও পাঙ্গী তহশীল এ তিনটি লোকসভা এবং দুটি বিধানসভা আসনে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। নভেম্বর মাসে এই অঞ্চল বরফাবৃত থাকতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই নির্বাচন কমিশন এই অঞ্চলে ১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২রা নভেম্বরের মধ্যে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এই অঞ্চল এতটাই দুর্গম ছিল যে পন্ডিত নেহেরুও নির্বাচনী প্রচারে চিনি অঞ্চলে যেতে পারেননি। ২৫ অক্টোবর ১৯৫১ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এই চার মাস ব্যাপী সারাদেশে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। সারাদেশে ১৭,৩২,১৩,৬৩৫ জন তালিকাভুক্ত ভোটারের ৪৫.৬৭ শতাংশ অর্থাৎ ১০,৫৯,৪৪,৪৯৫ জন ভোটার লোকসভা নির্বাচনে ভোটদান করেন। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটার সংখ্যা ছিল ১০,৩৮,০১, ১৯৯টি। একাধারে ভোটগ্রহণ এবং ফল ঘোষণার কাজ চলতে থাকে সারা দেশব্যাপী। সারাদেশে ৭,০০,০০০ ভোট কর্মী ২,২৪,০০০ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভোট কার্য পরিচালনা করেছিলেন । এই মহাযজ্ঞে প্রশাসনিক সহায়তায় শামিল হয়েছিলেন ২,২৪, ০০০ বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশকর্মী। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পটভূমিতে রাজনৈতিক দ্বৈরথ বর্তমান সময়ের মতো কলুষিত না হলেও একেবারে বিষমুক্ত ছিল না। তবে রাজনৈতিক হানাহানির বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের 'জুয়া খেলায়' সুকুমার সেনের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিল এবং সদ্য স্বাধীন একটি দেশ সারা বিশ্বের কাছ থেকে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল। ভারতবর্ষের প্রথম সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে সারা বিশ্ব যে উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছিল তা আজও দেশবাসীকে গর্বিত করে। ওয়াশিংটনে কর্মরত শ্রী এম কৃপালিনী পিটিআইকে এক সাক্ষাৎকারে (৭ জানুয়ারি ১৯৫২) বলেন " ভারতবর্ষের সাধারণ নির্বাচনের অগ্রগতি আমেরিকা বাসি অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা বিপুল সংখ্যক ভারত দেশবাসীর নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিষ্ময় প্রকাশ করেন। তারা ভারতবর্ষের অবাধ এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচন সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন " এই নির্বাচন সম্পর্কে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২২ শে জানুয়ারি ১৯৫২ উচ্ছাসিত প্রশংসা করে লেখা হয় “ভারতবর্ষের অধিকাংশ অংশে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন অত্যন্ত পরিপক্ক দক্ষ এবং সততার সাথে পরিচালিত হয়েছে । এই নির্বাচন যারা প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের উন্মুক্ত প্রশংসা পরিচালকমন্ডলী প্রাপ্য। " এসোসিয়েট প্রেস অফ অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি স্যার লয়েড দুমাস কলকাতায় ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন - "সংবাদপত্রের মানুষ হিসেবে আমরা সমগ্র ভারতবর্ষের প্রাপ্তবয়স্ক ভোট দাতা দ্বারা পরিচালিত ভোট প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি এই নির্বাচন কার্যক্রম এতটা সফল হবে । সারা বিশ্বের মানুষ ভারতবর্ষের এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত বিস্মিত এবং অভিভূত।" নির্বাচনে পরাজিত সমাজবাদী দলের প্রবাদ প্রতীম নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ ভারতবর্ষে নির্বাচনকে মুক্ত এবং অবাধ আখ্যায়িত করে বলেন। " প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের দেশের ভোটদাতারা তাদের অসাধারণ গণতান্ত্রিক চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। ভারতবর্ষের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শ্রী সুকুমার সেন মহাশয় কে সাধারণ নির্বাচন প্রক্রিয়া অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং সাংবিধানিক উপায়ে সম্পন্ন করার জন্য জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।" দেশের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন অবশেষে তাঁর লক্ষ্যে সফল হয়েছিলেন এবং যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ১৩ মে পন্ডিত জহরলাল নেহেরু নেতৃত্বে ২১ জন মন্ত্রী কে নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত হয়েছিল প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের প্রথম মন্ত্রিসভা। ​

No comments: