Saturday, February 25, 2023

Bengali Almanac: An Uncharted Area of Indian Mass Communication

Author : Dr Nilay Kumar Saha Specifications ISBN : 9788195331222 Year : 2022 Language : English Binding : Hardbound Price: Rs 1500 Publisher: Indian Council of Historical Research About the book "Benaglai Almanac" was handwritten on palm leaf at the early stage of civilization. The introduction of printing technology and the growing demand of almanac in the society ushered in a new route of investment for the investors. The rich men of the then society took the opportunity and the number of printed Bengali almanac increased rapidly. To be precise, it was the competitive attitude to reach out to the largest possible market among the publishers of Bengali almanac which prompted them to incorporate information from diverse fields along with the basic content in their publications. For a period of two hundred years the remarkable contributions of te publishers of Bengali almanac provide a rich repository of information relating to almost all aspects of human civilization along with many remarkable and interesting advertisements. But unfortunately these immensely useful materials pertaining to Indian communication system have not yet been explored properly. Such extremely important components remained ignored in writing the history of Indian mass communication. The history of Indian mass communication system thus incomplete and even unreliable. The present work is a unique attempt to explore the glorious role of Bengali almanc in shaping the very basis the Indian mass communication system which so far remained grossly neglected. Expert opinon Dr. Nilay Kumar Saha has completed this important study as part of the Indian Council of Historical Reserach "Senior Academic Fellowship" scheme. This volume comprising 21 chapters covers almost all areas of civil society that were published in different Bengali almanac either in the form of information or in the form of an advertisement. Dr. Saha's hard work and sound research methodolody hade made a major contribution. The ICHR stands well rewarded with regard to having supported the study as part of its Senor Fellowship programme. I congratulate Dr. Saha for this very good publication.

Bangla Panjikay Purono Kolkata

Description of the book Title: Bangla Panjikay Purono Kolkata Author: Nilay Kumar Saha Publisher: Setu Prakashani Place: Kolkata, West Bengal ISBN: 978-81-950222-7-4 Year of publication: March 2022 Pages: 312, Hard Bound Price: Rs 500 About the Book This valuable work provides a rich repository of information that will potentially unleash new trends in writing the social history of colonial urban Calcutta. Reconstructing this history on the basis of printed almanacs will prove to be as innovative and useful a project as were once the lists provided by James Long on Bengali print culture, Dinesh Sen’s compilation of ballads and folk literature of east Bengal or Panchanan Mondol’s researches on early modern manuscripts. Nilay Saha’s work stands testimony to persistence, patience and painstaking labour and I take this occasion to congratulate Setu Prakashani for supporting this valuable enterprise. Amiyaprosad Sen Hony. Fellow, Oxford Centre for Hindu Studies, Oxford

84th Conference of WBCUTA

দেশহিতৈষী > ই-দেশহিতৈষী ৬০ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ৪ ফাল্গুন, ১৪২৯ উচ্চশিক্ষা বাঁচাতে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে তীব্রতর সংগ্রামের ডাক ওয়েবকুটা’র নিলয়কুমার সাহা কোভিড অতিমারীর অভিশপ্ত সময় অতিক্রম করে দীর্ঘ চার বছর পর গত ১১-১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারে অনুষ্ঠিত হলো পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (ওয়েবকুটা)-র ৮৪তম সম্মেলন এবং ৯৪তম বার্ষিক সাধারণ সভা। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলির চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রবীণ এবং নবীন অধ্যাপকদের প্রাণোচ্ছ্বল উপস্থিতিতে দেশ তথা রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের স্বার্থ রক্ষার্থে সম্মেলন মঞ্চেই ঘোষিত হলো অধ্যাপক সমিতির আপসহীন আন্দোলন কর্মসূচি। এই আন্দোলন কর্মসূচির প্রেক্ষাপট জানতে আমাদের ফিরতে হবে ২০১১ সালে। ২০১১ সালের ১৩ মে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালা বদলের পর রাজ্যের প্রথম শহিদ বিদ্যালয় শিক্ষক জিতেন নন্দী। পরবর্তী সময়ে রাজ্যের মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘ছোটো ছোটো ছেলেদের’ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। বিগত এক দশকে রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্যে বিদ্যালয় স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত রাজনৈতিক দখলদারি কায়েম করতে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে দীর্ঘ সময় সযত্নে লালিত সমস্ত গণতান্ত্রিক পরিচালন পরিকাঠামো। রাজনৈতিক এই দখলদারির আইনি রূপ দিতে বিরোধীশূন্য বিধানসভায় পাশ হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ (প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৭’। বর্তমানে রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের বৈধতা আদালতে বিচারাধীন। কেবলমাত্র কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে অযোগ্য শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করে ক্ষমতাসীন সরকার কেবল রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থাকে কালিমালিপ্ত করেনি, ছারখার করে দিয়েছে যোগ্য হবু শিক্ষকদের সোনালী ভবিষ্যৎ। বর্তমান বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের তুলনায় প্রায় চার লক্ষ কমে যাওয়ার পিছনে সীমাহীন এই দুর্নীতির প্রভাবও কি বর্তমান? এই প্রশ্নের উত্তর রাজ্য সরকারকেই দিতে হবে। প্রায় দু’বছর যোগ্য হবু শিক্ষক এবং হবু শিক্ষাকর্মীদের রাজপথে ধরনামঞ্চের ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচিতেই প্রতিফলিত হয় ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ সম্পূর্ণ দুর্নীতিগ্রস্ত এই সরকারের অমানবিক চেহারা। সরকার বিরোধী যে কোনো আন্দোলন কর্মসূচি বানচাল করতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়ংকর রূপ। তমসাচ্ছন্ন এই গভীর সংকটময় মুহূর্তে একমাত্র ভরসার জায়গা দেশের বিচারব্যবস্থা। যদিও সামগ্রিকতার বিচারে দেশের বিচারব্যবস্থাও আজ নানান প্রশ্নের সম্মুখীন। ওয়েবকুটা রাজ্যের শিক্ষা মূলত উচ্চশিক্ষার উপর যাবতীয় রাষ্ট্রীয় আঘাত রাস্তায় নেমে আন্দোলনের পাশাপাশি মহামান্য আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রতিরোধ করতে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যেই শিক্ষার স্বার্থে, শিক্ষকদের স্বার্থে ওয়েবকুটা কালাকানুন - ‘পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ (প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৭’ প্রত্যাহারের দাবিসহ আরও একাধিক পেশাগত দাবিতে মহামান্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পেয়েছে, যা অধ্যাপক সমিতির লড়াইকে আরও উদ্দীপিত করেছে। ভারত সরকার ২০১৯ সালে প্রকাশ করে ‘খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৯’। স্বাধীনোত্তর ভারত ১৯৬৮ সালে এবং ১৯৮৬ সালে প্রত্যক্ষ করেছে দুটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতি। প্রায় চার দশক পর অন্তত সময়ের নিরিখে এই খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা যায় না। এই খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে বেশ কিছু আকর্ষণীয় শব্দবন্ধ যেমন - ‘করপোরেট ফিলানট্রপি’, ‘অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট’, ‘ডিজিটাল লকার’, ‘ম্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোরসেস’, ‘ডিজিটাল লার্নিং,’ ‘ওপেন এন্ট্রি অ্যান্ড ওপেন একজিট’ ইত্যাদি ব্যবহৃত হলেও বিবেচিত হয়নি ভারতের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো, উপেক্ষিত হয়েছে নাগরিক মূল্যবোধ, আলোচিত হয়নি অর্থনৈতিক অসাম্যের কারণে ক্রমবর্ধমান বিদ্যালয়-ছুটের বাস্তব সমস্যা, অভাব রয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতার। পাশাপাশি গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে গুরুকুল, মাদ্রাসা, গৃহবিদ্যালয় এবং ধর্মশিক্ষা বিদ্যালয়ের উপর। বহুমুখী উচ্চশিক্ষার প্রসারে প্রস্তাবিত এই শিক্ষানীতিতে বহুবার ‘তক্ষশীলা’ এবং ‘নালন্দা’র কথা উল্লেখিত হয়েছে। উল্লেখিত হয়েছে ভারতীয় প্রাচীন কল্যাবিদ্যার ৬৪ কলার কথাও। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ তালিকাভুক্ত একটি বিষয় হলেও, এই প্রথম আলোচ্য খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের কুক্ষিগত করার স্পষ্ট আয়োজন বর্তমান ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতির নানান সীমাবদ্ধতার উপর আলোকপাত করা হয়। দেশের সর্বপ্রাচীন এবং সর্ববৃহৎ শিক্ষক সংগঠন ঐতিহ্যের পরম্পরা অনুসরণ করে এই বিষয়েও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এবং পরিমার্জন সংক্রান্ত মতামত যথা সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকে পাঠায়। সারা পৃথিবীসহ ভারত যখন কোভিড অতিমারীতে পর্যুদস্ত, কেন্দ্রের হঠকারী সিদ্ধান্তের পাশাপাশি রাজ্যের প্রকৃত তথ্য গোপনের কৃতকৌশলে মানুষ যখন দিশাহারা, জীবন-মৃত্যুর দোলায় দুলতে দুলতে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ২০২০ সালের ২৯ জুলাই ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’র আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ। খসড়া প্রস্তাবে কিছু অদল বদল করে কাঠামো এবং দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত রেখেই ঘোষিত হয়েছে এই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি। ব্যয়বরাদ্দের দিক্‌নির্দেশ না থাকলেও আছে শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোর আমূল পরিবর্তনের বাধ্যবাধকতা, যা বাস্তবে শিক্ষাক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে। এই সু‍‌যোগে বিদেশি বিনিয়োগের হাত ধরে ভারতীয় শিক্ষা পর্যবসিত হবে বিত্তবান দেশবাসীর কাঙ্ক্ষিত ‘পণ্যে’ যা নিশ্চিতভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার পথ প্রশস্ত করবে। শিক্ষাব্যবস্থার উপর কেন্দ্র ও রাজ্যের সুপরিকল্পিত যৌথ আক্রমণ প্রতিহত করার সংকল্প নিয়ে ওয়েবকুটার এই সম্মেলনে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’-র প্রেক্ষাপটে আয়োজন করা হয়েছিল ‘স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরঃ দেশের শিক্ষাচিত্র’ শীর্ষক এক জাতীয় পর্যায়ের আলোচনা সভা। ওই আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্ত, অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্ত শিক্ষার গুণগত মানের উপর আলোকপাত করে বলেন, ‘‘শিক্ষাব্যবস্থা দৃশ্যত আকষর্ণীয় হলেই চলবে না, পাঠক্রম এবং পাঠক্রমের বিষয়বস্তু বিচার করতে হবে। পাশ্চাত্য শিক্ষা যেমন পাঠক্রমে থাকবে, তেমনি থাকবে দেশজ ভাবনা ও সংস্কৃতির উপস্থিতি। দেশজ ভাবনা ও সংস্কৃতির গোঁড়ামিও কাঙ্ক্ষিত নয়, কারণ গোঁড়ামি থেকে জন্ম নেয় মৌলবাদ। বর্তমান শিক্ষানীতি নয়া ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করতে বদ্ধপরিকর, যা প্রতিহত করা আশু কর্তব্য।’’ আলোচনায় অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর বলেন, ‘‘উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়সংকোচ নীতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঠেলে দিচ্ছে করপোরেট হাউসের হাতে। দেশের শিক্ষানীতি প্রণয়নে শিক্ষকদের মতামতের তোয়াক্কা না করে কেন্দ্রীয় সরকার একমুখী কেন্দ্রীকতার পথই উন্মুক্ত করেছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধিকার কেড়ে নেওয়া চলতে পারে না।’’ অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘‘কোভিড অতিমারীতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। কোভিডোত্তর পর্যায়ে যাবতীয় শক্তি প্রয়োগ করে শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ না নিয়ে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির প্রণয়ন সন্দেহের জন্ম দেয়। এই শিক্ষানীতিতে যে ‘চয়েজ বেস ক্রেডিট সিস্টেম’-এর কথা বলা হয়েছে সেখানে চয়েজের কোনো সুযোগ নেই। ২০২০ সালের শিক্ষানীতি যে যে দিক্‌নির্দেশ করে তা কার্যকর করতে যে পরিকাঠামো প্রয়োজন তা আমাদের নেই। ওই পরিকাঠামোর অসম্পূর্ণতা কার্যত ‘ড্রপ আউট’-কেই আইনসিদ্ধ করে তুলবে।’’ সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘‘স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার হলো। ঢক্কানিনাদে পালিত হলো ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’, নাকি ‘আজাদি কা গরল বহ্ন্যুৎসব?’ আমাদের অনেকের মনে এমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আমরা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ‘ইনডিপেনডেন্স’ পেলেও ‘ফ্রিডম’ পাইনি। বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি ‘ইতিহাস অনুসন্ধান’-এ নয়, আগ্রহী ‘ইতিহাস পুনর্নির্মাণ’-এ। ইতিহাস চেতনা এবং বিজ্ঞান সংস্কৃতির উপর পরিকল্পিত আক্রমণ আমাদের প্রতিহত করতেই হবে।’’ সম্মেলনের উদ্বোধক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বহুমাত্রিক দেশ ভারতে বহুমুখী শিক্ষাক্রমের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ‘‘ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মে শাসক ব্রিটিশের আধিপত্য থাকলেও অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মহাত্মা গান্ধী, মদনমোহন মালব্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকলেই বিকল্প শিক্ষা চিন্তার বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেসব শিক্ষা চিন্তার বাস্তবিক প্রয়োগ এবং সুফল আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য কখনোই জীবিকার্জন নয়, যদিও শিক্ষার অভিমুখ কর্মমুখী হওয়াও অবাঞ্ছিত নয়। তবে লক্ষ রাখতে হবে কোনো অবস্থাতেই জীবিকার দোহাই দিয়ে শিক্ষাকে ‘পণ্যে’ পরিণত করা চলবে না। যদিও বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি ‘করপোরেট’ এবং ‘হিন্দুত্ববাদ’কে পুঁজি করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। এই অশুভ প্রয়াস সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিককে প্রতিহত করতেই হবে। আর এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেবেন আপনারা - শিক্ষক সমাজ।’’ সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের অধ্যক্ষ স্বামী সুপর্ণানন্দজি মহারাজ তাঁর বক্তব্যে শিক্ষকদের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের আমলা, প্রশাসক, বিচারক সবই আপনাদের তৈরি, কিন্তু পরিতাপের হলেও সত্য, আপনারা সকলেই এই তিনটি শ্রেণি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। শিক্ষক সমাজ তৈরির কারিগর। কাজেই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আপনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব, কর্তব্য আপনাদের সম্পাদন করতে হবে।’’ সম্মেলনের শেষ পর্বে সম্মেলন মঞ্চ থেকে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ প্রত্যাহারের দাবির পাশাপাশি রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত করতে পথে নেমে আপসহীন সংগ্রামের ডাক দেয় ওয়েবকুটা।

Newscope First Election in India

২৫ জানুয়ারি -জাতীয় ভোটার দিবস, ফিরে দেখা দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন নিলয়কুমার সাহা ২৫ অক্টোবর ১৯৫১ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এই চার মাস ব্যাপী সারাদেশে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। সারাদেশে ১৭,৩২,১৩,৬৩৫ জন তালিকাভুক্ত ভোটারের ৪৫.৬৭ শতাংশ অর্থাৎ ১০,৫৯,৪৪,৪৯৫ জন ভোটার লোকসভা নির্বাচনে ভোটদান করেন। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটার সংখ্যা ছিল ১০,৩৮,০১, ১৯৯টি। একাধারে ভোটগ্রহণ এবং ফল ঘোষণার কাজ চলতে থাকে সারা দেশব্যাপী। সারাদেশে ৭,০০,০০০ ভোট কর্মী ২,২৪,০০০ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভোট কার্য পরিচালনা করেছিলেন । এই মহাযজ্ঞে প্রশাসনিক সহায়তায় শামিল হয়েছিলেন ২,২৪, ০০০ বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশকর্মী। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পটভূমিতে রাজনৈতিক দ্বৈরথ বর্তমান সময়ের মতো কলুষিত না হলেও একেবারে বিষমুক্ত ছিল না। তবে রাজনৈতিক হানাহানির বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের 'জুয়া খেলায়' সুকুমার সেনের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিল এবং সদ্য স্বাধীন একটি দেশ সারা বিশ্বের কাছ থেকে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল। ভারতবর্ষের প্রথম সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে সারা বিশ্ব যে উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছিল তা আজও দেশবাসীকে গর্বিত করে। ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি দিনটিকে তদানীন্তন ভারত সরকার জাতীয় ভোটার দিবস হিসাবে ঘোষণার পাশাপাশি প্রতিবছর ওই দিনটিকে জাতীয় ভোটার দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দিনটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পৌঁছতে হলে সময় যন্ত্রে আমাদের আটটি দশক পিছনে ফিরে যেতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ সংসদ 'ইন্ডিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্টস অ্যাক্ট ১৯৪৭' অনুমোদন করে এবং ওই আইন অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পন্ডিত জহরলাল নেহের স্বাধীন ভারতবর্ষের তদারকি সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী রূপে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন তদারকি সরকার দেশ পরিচালনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সংসদীয় পরিকাঠামো রচনায় ব্রতী হন। স্বাধীন দেশের সংবিধান রচয়িতারা এই কাজ ত্বরান্বিত করতে ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ শাসনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনের নীতি অনুসরণ করেন। এই নীতি বাস্তবায়নের সংবিধান প্রনেতারা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তা হল কেবলমাত্র অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনই প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি যা সুদৃঢ় সংসদীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সক্ষম। তাদের মতে স্বাধীন নিরপেক্ষ এবং কার্যকরী একটি সংস্থা অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন সুনিশ্চিত করতে সক্ষম। এমতাবস্তায় সংবিধান রচয়িতারা ইউনাইটেড কিংডমের কেন্দ্রীয় নির্বাচন আয়োগ এর ধারণা এবং ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার প্রাদেশিক নির্বাচন আয়োগ এর ধারণার তুলনামূলক পর্যালোচনা মধ্যে দিয়ে সারাদেশে নির্বাচনী কার্যক্রমে সমতাবিধানের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় নির্বাচন আয়োগের ধারণাটি গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হলেও নাগরিকত্ব আইনের ৫,৬,৭,৮,৯ নম্বর ধারা এবং সংবিধানের ৩২৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ভারতীয় নির্বাচন আয়োগ। ভারতীয় নির্বাচন আয়োগ এর কার্যক্রম শুরু হয় ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হওয়ার একদিন আগে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৫ জানুয়ারি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার একষট্টি বছর পর। ২৫ জানুয়ারি দিনটিকে জাতীয় ভোটার দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্বাধীন ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ , আইসিএস সুকুমার সেনকে রাজ্যের প্রথম মুখ্য সচিবের পদে নিযুক্ত করেন এবং ওই পদে শ্রী সেন ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সুপারিশেই প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার সুকুমার সেনকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে নিযুক্ত করেন । ১৯৫০ সালের ২১ মার্চ থেকে ১৯৫৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুকুমার সেন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময়ে তার নেতৃত্বে ১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালের দেশের দুটি সাধারণ নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। দায়িত্ব গ্রহণের ১ বছর ৭ মাসের মধ্যে শ্রী সেন দেশের ১৪ টি জাতীয় এবং ৬৩ টি প্রাদেশিক ও স্থানীয় রাজনৈতিক দলের মোট ১৭৫০০ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণের উদ্দেশ্যে যে কর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন তা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। ২১ বছর বয়সোর্ধ ৭৬ মিলিয়ন ভারতবাসীকে তিনি গণতন্ত্রের এই উৎসবে ভোট দানকারী হিসেবে যুক্ত করেছিলেন , যাদের শতকরা ৮৫ শতাংশ ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন। সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর ভোটদাতাদের দ্বারাই নির্বাচিত হয়েছিল স্বাধীন দেশের ৪৮৯ আসন বিশিষ্ট লোকসভা এবং ৩২৮৩ আসন বিশিষ্ট বিভিন্ন প্রাদেশিক বিধানসভার জনপ্রতিনিধিগণ। এই জনপ্রতিনিধিদের হাত ধরেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের। শ্রী সেন কিভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন তা আজ ইতিহাস। সারা বিশ্ব চরম বিষয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের মহাযজ্ঞ। সুকুমার সেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নির্বাচন আয়োগএর যথার্থ পরিচালনায় এবং দেশবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণে রচিত হয়েছিল ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের মহাকাব্যিক ইতিহাস। পন্ডিত নেহেরুর ভাষায় " আমরা ছোট মাপের মানুষ কিন্তু যোগ দিয়েছি বিরাট এক কাজে। এই কাজটা বিরাট , তাই বিরাটত্বের কিছুটা ছোঁয়া আমাদের গায়েও এসে লাগে। সে কৃতিত্বের আঁচ আজ আমরা পাই" দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন পরিচালনায় সুকুমার সেনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন আয়োগ দেশের সংবিধান, ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে অনুসৃত নির্দেশিকা অনুসরণ করে নানান প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সারাদেশে নির্বাচন কেন্দ্রের বিন্যাস , পুনর্বিন্যাস , সংরক্ষিত আসন নির্দিষ্টকরণ, ক্রমবর্ধমান উদ্বাস্তু সমস্যা এবং সর্বোপরি ভোটার তালিকা প্রণয়নের মত অত্যন্ত দুরূহ কাজের পাশাপাশি অধিকাংশ নিরক্ষর ভোটদাতার ভোটগ্রহণ এবং ফল ঘোষণার কাজ যে দক্ষতা , দ্রুততা এবং দৃঢ়তার সাথে সম্পাদন করেছিলেন তা আজও আমাদের বিস্মিত করে। প্রধানত পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে ভারতবর্ষ মুখী হিন্দুদের বিরামহীন স্রোতের কারণে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন পরিচালনায় ভোটার তালিকা প্রস্তুতির কাজ বারবার ব্যাহত হয়েছিল। পাশাপাশি তুলনায় কম হলেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে মুসলমানদের পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ এবং বারবার বর্ধিত নির্দিষ্ট তারিখের প্রেক্ষিতে ২১ বছর বয়স উর্ধ দেশবাসীকে চিহ্নিতকরণের সমস্যাও ভোটার তালিকা প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। এই সমস্যা সঙ্কুল পরিস্থিতিতে দেরি হলেও নির্বাচন আয়োগ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ভোটার তালিকা প্রস্তুত, প্রাথমিক ভোটার তালিকা প্রকাশ এবং সর্বোপরি ভোটার তালিকা সংশোধন ও সংযোজন এর কাজ সম্পাদন করেছিল। দেশের সর্বাধিক জনসাধারণকে আইনে বর্ণিত নির্দেশ অনুসারে ভোট উৎসবে শামিল করাই ছিল নির্বাচন আয়োগের লক্ষ্য। এই প্রসঙ্গে শ্রী সেন ঘোষণা করেন " আইন অনুসারে পরিবর্তিত যোগ্যতা মানের বয়েস এবং তারিখ অনুযায়ী সকল যোগ্য নাগরিক ভোটার তালিকায় যুক্ত হবেন। এই কাজ সবেমাত্র আরম্ভ হয়েছে।। প্রসঙ্গত আগের ভোটার তালিকা সম্পর্কিত কোন অভিযোগই আসেনি। যদি কোন নির্দিষ্ট অঞ্চল অথবা রাজ্য অথবা কোন নির্বাচন কেন্দ্রের ভোটার তালিকা সংক্রান্ত নির্দিষ্ট অভিযোগ আসে তাহলে অবশ্যই আমরা সেই অভিযোগ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখব। যদি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুতির পরেও দেখা যায় কিছু যোগ্য নাগরিক ভোটার তালিকায় যুক্ত হননি তবে সেক্ষেত্রেও ভোটার তালিকা সংযোজিত হবে।" প্রসঙ্গত উল্লেখ্য চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে শ্রী সেন লক্ষ্য করেন উত্তর ভারতের প্রায় ২৮ লক্ষ মহিলা ভোটার কারোর কন্যা , কারোর স্ত্রী অথবা কারোর মা এই নামে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। বিষয়টি নজরে আসা মাত্রই শ্রী সেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের নির্দেশ দেন ওই ভোটারদের নিজে নিজে নামে তালিকাভুক্ত করনের। কিন্তু ওই মহিলাগণ নিজের নামে তালিকাভুক্ত হতে অসম্মত হওয়ায় আইনের রক্ষক শ্রী সেনের নির্দেশেই ওই ২৮ লক্ষ মহিলা ভোটারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। যদিও শ্রী সেনের ঐকান্তিক প্রয়াসেই ওই মহিলা ভোটারগণ দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে নিজের নিজের নামেই ভোটার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য পৃথক পৃথক নির্বাচনী প্রতিক নির্দিষ্টকরণের মধ্য দিয়ে, সুকুমার সেন পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ক্ষেত্র নির্মাণ করেছিলেন। শ্রী সেন উপলব্ধি করেছিলেন দেশের ৮৫% অক্ষর জ্ঞানহীন ভোটারদের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বহু রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে থেকে কেবলমাত্র নামের ভিত্তিতে পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেওয়া অসম্ভব। সেই কারণেই তিনি প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার্য নানান উপকরণ যেমন জোড়া বলদ, হাতি, কাস্তে হাতুড়ি, প্রদীপ, উদীয়মান সূর্য, মানুষের হাত, দন্ডায়মান সিংহ ইত্যাদি নির্দিষ্ট করেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে। শ্রী সেনের উদ্ভাবনী ভাবনার সার্থক প্রয়োগের ফলশ্রুতিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন কারণে বাজেয়াপ্ত ভোটের পরিমাণ ৪ শতাংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। উত্তর আধুনিক ভারতবর্ষ আজও সুকুমার সেন সৃষ্ট পথেই ধাবমান।। কেবল নির্বাচনী প্রতীকই নয়, ভোট বাক্স এবং ভোটপত্রের নকশা শ্রী সেন নিজেই প্রস্তুত করেছিলেন। লোকসভা এবং বিধানসভার জন্য আলাদা রঙের ভোট বাক্স এবং ভোটপত্রের ব্যবহারের নির্দেশ এবং জাল ভোট রুখতে অনপনেয় কালীর ব্যবহারের পরিকল্পনাও তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৯৫৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সুকুমার সেন প্রকাশিত রিপোর্ট "অন দা ফাস্ট জেনারেল ইলেকশন ইন ইন্ডিয়া ১৯৫১ - ৫২ " থেকে জানা যায় ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার জন্য - টাইপ এবং ক্রমানুক সাজানোর জন্য ১৬৫০০ কর্মীকে চুক্তি ভিত্তিতে ছ মাসের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। ৩৮৪২১৫ রিম কাগজের ব্যবহার হয়েছিল ভোটপত্র তৈরি করতে। ভোট দানের পর ভোটপত্র সংরক্ষণের জন্য ২ মিলিয়ন অর্থাৎ কুড়ি লক্ষ ভোট বাক্স তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়েছিল ৮২০০ টন স্টিল এবং জাল ভোট রুখতে ব্যবহৃত হয়েছিল ৩৮৯৮১৬ ফাইল কালি। শ্রী সেনের অনুরোধেই সমকালীন বিজ্ঞানীরা এমন কালি প্রস্তুত করেছিলেন যা দেহের কোন অংশে একবার লাগলে দীর্ঘদিন তা উজ্জ্বল থাকবে। এই প্রসঙ্গে এক মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শ্রী টি এন সেশনের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। কারণ সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য তিনি সচিত্র ভোটার পত্রের প্রবর্তন করেন। প্রচারবিমুখ সুকুমার সেন দেশের আপামার জনসাধারণকে নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে সচেতন এবং আত্মনির্ভর করে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং এই কাজ যথাযথ সম্পাদনে শ্রীসেন বেতার ,মুদ্রণ এবং চলচ্চিত্র ইত্যাদি মাধ্যমকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৫১ সালের ২৭ জুন দিল্লি অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে ভোটারদের উদ্দেশ্যে শ্রী সুকুমার সেন এর – ‘কিভাবে একটি ভোট দান হবে’ শীর্ষক বক্তৃতা সম্প্রচারিত হয় । এই বেতার বার্তায় শ্রী সেন বলেন " দেশের বাতাসে এখন ভোটের গন্ধ এবং এই সময় দেশের জনসাধারণকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। যে সকল জনগণ তাদের আইনসম্মত অধিকারের বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন তারা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত ভোটার তালিকা পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছেন। আনুমানিক দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। কিভাবে ভোট দিতে হবে , এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন একটি ভোটপত্রের ওপর ভোটদাতার কর্তব্য সম্পর্কে কোন চিহ্ন বা নির্দেশিকার উল্লেখ থাকবে না। প্রত্যেক প্রার্থীকে একটি করে ভোট বাক্স বরাদ্দ করা হবে এবং ওই বাক্সের উপর ওই প্রার্থীর নির্বাচনী প্রতীক পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হবে। ভোটদাতা এই প্রতীক নির্দেশিত তার পছন্দের প্রার্থীর ভোট বাক্সে ভোটপত্রটি ফেলে দেবেন। মনে রাখতে হবে বহু আসন বিশিষ্ট নির্বাচনী কেন্দ্রের ক্ষেত্রে কোন ভোটদাতাই একটি ভোট বাক্সে একের অধিক ভোটপত্র ফেলবেন না। যদি কোন ভোটদাতাএই কাজ করেন তবে একটি ছাড়া সকল ভোট বাতিল বলে গণ্য হবে।“ মিথ্যা ছদ্মবেশ সম্পর্কে শ্রীসেন বলেন " অতীতে যেখানে সেখানে মিথ্যা ছদ্মবেশের অশুভ প্রয়োগ ছিল এই বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন করে কোন ভোট দাতাকে ভোটপত্র দেবার আগেই সেই ভোটদাতার তর্জনীতে অক্ষয় কালী নিয়ে দাগ দিয়ে দিতে হবে। একজন ভোটদাতা একবার ভোট দেয়ার পর পুনরায় ভোট দিতে পারবেন না কারণ সেই ভোটদাতা তর্জনীতে দেওয়া অক্ষয় কালির ছাপ ৭ থেকে ১০ দিন বিরাজ করবে। যদি কোন ভোটার ছদ্মবেশে অন্য কোন ভোটদাতার ভোট দিয়ে দেন তবে তিনি নিজের ভোট আর দিতে পারবেন না , কারণ প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ভোটার হিসেবে ভোটকেন্দ্রে যায়।" ভোট কেন্দ্রে ভোটারের যাতায়াত প্রসঙ্গে শ্রী সেন বলেন অতীতে প্রত্যেক ভোটদাতাই প্রার্থীর খরচে কোন গাড়িতে বা অন্য কোন উপায় ভোটকেন্দ্রে পৌঁছতেন। বর্তমানে প্রার্থী কর্তৃক ভোট দাতাদের জন্য ভোটের দিন যানবাহনের ব্যবস্থা করা ফৌজদারী অপরাধ বলে পরিগণিত হবে।। কাজেই ভোটদাতা নিজেদের খরচায় যানবাহনের ব্যবস্থা করে অথবা পায়ে হেঁটে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছাইবেন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করিবেন।" ১৯৫১ সালে নভেম্বর মাসে অল ইন্ডিয়া রেডিওর বাইশটি সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে ' ভারতীয় সংবিধান' 'প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার' 'ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ' ইত্যাদি বিষয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল। কেবল দিল্লি অল ইন্ডিয়া রেডিও শ্রী সুকুমার সেনের নির্বাচন বিষয়ক সাতটি বক্তৃতা সম্প্রচার করে। সম্ভবত সুকুমার সেনের উদ্যোগেই ভারতবর্ষের তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রকের ফিল্ম ডিভিশন Right and responsibility শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র প্রস্তুত করে। এই তথ্যচিত্রে মূলত ভোটারদের কাজ এবং কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছিল। 'ফিল্ম ডিভিশন' কতৃক তথ্যচিত্রটি ১৯৫১ সালের মার্চ মাসের শেষে তিন হাজারেরও বেশি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছিল। ওই বছরই 'ফিলম ডিভিশন' 'ডেমক্রেসি ইন অ্যাকশন' শীর্ষক আরেকটি ছবি ইংরেজি সহ আটটি প্রাদেশিক ভাষায় প্রস্তুত করে। নির্বাচন আয়োগ এর অনুরোধে ৭০ মিলিয়ন ভারতবাসীকে সঠিক উপায়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ অর্থাৎ ভোটদানে সক্ষম করে তুলতে 'ফিল্ম ডিভিশন' এই তথ্যচিত্রটি সারাদেশে ৬ সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শ্রী সুকুমার সেন ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে রাজ্যভিত্তিক নির্বাচন নির্ঘণ্ট চূড়ান্ত করেন। লোকসভার ৪৮৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ২৮৩৩টি মনোনয়নপত্র এবং সারাদেশের রাজ্য বিধানসভা গুলিতে ৩২৮৩ টি আসনের জন্য ২৩,২৮৭ টি মনোনয়নপত্র দাখিল হয়। এই বিপুল সংখ্যক মনোনয়নপত্র পরীক্ষা এবং প্রত্যাহারের পর লোকসভায় ১৮৭৪ জন এবং রাজ্য বিধানসভায় ১৫,৬৩১ জন প্রতিদ্বন্দ্বি নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অবশেষে স্বাধীনতার ভারতবর্ষে ১৯৫১ সালে ২৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার তিব্বত সীমান্তবর্তী হিমাচল প্রদেশের চিনি ও পাঙ্গী তহশীল এ তিনটি লোকসভা এবং দুটি বিধানসভা আসনে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। নভেম্বর মাসে এই অঞ্চল বরফাবৃত থাকতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই নির্বাচন কমিশন এই অঞ্চলে ১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২রা নভেম্বরের মধ্যে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এই অঞ্চল এতটাই দুর্গম ছিল যে পন্ডিত নেহেরুও নির্বাচনী প্রচারে চিনি অঞ্চলে যেতে পারেননি। ২৫ অক্টোবর ১৯৫১ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এই চার মাস ব্যাপী সারাদেশে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। সারাদেশে ১৭,৩২,১৩,৬৩৫ জন তালিকাভুক্ত ভোটারের ৪৫.৬৭ শতাংশ অর্থাৎ ১০,৫৯,৪৪,৪৯৫ জন ভোটার লোকসভা নির্বাচনে ভোটদান করেন। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটার সংখ্যা ছিল ১০,৩৮,০১, ১৯৯টি। একাধারে ভোটগ্রহণ এবং ফল ঘোষণার কাজ চলতে থাকে সারা দেশব্যাপী। সারাদেশে ৭,০০,০০০ ভোট কর্মী ২,২৪,০০০ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভোট কার্য পরিচালনা করেছিলেন । এই মহাযজ্ঞে প্রশাসনিক সহায়তায় শামিল হয়েছিলেন ২,২৪, ০০০ বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশকর্মী। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পটভূমিতে রাজনৈতিক দ্বৈরথ বর্তমান সময়ের মতো কলুষিত না হলেও একেবারে বিষমুক্ত ছিল না। তবে রাজনৈতিক হানাহানির বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের 'জুয়া খেলায়' সুকুমার সেনের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিল এবং সদ্য স্বাধীন একটি দেশ সারা বিশ্বের কাছ থেকে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল। ভারতবর্ষের প্রথম সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে সারা বিশ্ব যে উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছিল তা আজও দেশবাসীকে গর্বিত করে। ওয়াশিংটনে কর্মরত শ্রী এম কৃপালিনী পিটিআইকে এক সাক্ষাৎকারে (৭ জানুয়ারি ১৯৫২) বলেন " ভারতবর্ষের সাধারণ নির্বাচনের অগ্রগতি আমেরিকা বাসি অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা বিপুল সংখ্যক ভারত দেশবাসীর নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিষ্ময় প্রকাশ করেন। তারা ভারতবর্ষের অবাধ এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচন সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন " এই নির্বাচন সম্পর্কে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২২ শে জানুয়ারি ১৯৫২ উচ্ছাসিত প্রশংসা করে লেখা হয় “ভারতবর্ষের অধিকাংশ অংশে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন অত্যন্ত পরিপক্ক দক্ষ এবং সততার সাথে পরিচালিত হয়েছে । এই নির্বাচন যারা প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের উন্মুক্ত প্রশংসা পরিচালকমন্ডলী প্রাপ্য। " এসোসিয়েট প্রেস অফ অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি স্যার লয়েড দুমাস কলকাতায় ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন - "সংবাদপত্রের মানুষ হিসেবে আমরা সমগ্র ভারতবর্ষের প্রাপ্তবয়স্ক ভোট দাতা দ্বারা পরিচালিত ভোট প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি এই নির্বাচন কার্যক্রম এতটা সফল হবে । সারা বিশ্বের মানুষ ভারতবর্ষের এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত বিস্মিত এবং অভিভূত।" নির্বাচনে পরাজিত সমাজবাদী দলের প্রবাদ প্রতীম নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ ভারতবর্ষে নির্বাচনকে মুক্ত এবং অবাধ আখ্যায়িত করে বলেন। " প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের দেশের ভোটদাতারা তাদের অসাধারণ গণতান্ত্রিক চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। ভারতবর্ষের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শ্রী সুকুমার সেন মহাশয় কে সাধারণ নির্বাচন প্রক্রিয়া অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং সাংবিধানিক উপায়ে সম্পন্ন করার জন্য জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।" দেশের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন অবশেষে তাঁর লক্ষ্যে সফল হয়েছিলেন এবং যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ১৩ মে পন্ডিত জহরলাল নেহেরু নেতৃত্বে ২১ জন মন্ত্রী কে নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত হয়েছিল প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষের প্রথম মন্ত্রিসভা। ​